দি ড্রিমল্যান্ড-এর ভূমিকা
ভগৎ সিং
আমার মহান বন্ধু শ্রী এল রামশরণ দাশ তাঁর কাব্যগ্রন্থ দি ড্রিমল্যান্ড এর জন্য একটা ভূমিকা লিখে দিতে অনুরোধ করেছেন। আমি কবি বা সাহিত্যিক নই, সাংবাদিক অথবা সমালোচকও নই। সুতরাং কোনো কল্পনায়ই এ দাবির সমর্থন খুঁজে পাই না। অথচ যে অবস্থার মধ্যে আমি জড়িত হয়েছি, তাতে প্রশ্নের ভালমন্দ সম্পর্কে গ্রন্থকারের সঙ্গে আলোচনা করার কোনো সুযোগও আমার নেই। ফলত আমার বন্ধুর আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা ছাড়া অন্য কোনো পথও দেখি না।
[Read this article in english: Introduction To Dreamland - Bhagat Singh]
যেহেতু আমি কবি নই সেহেতু কবির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমি এর আলোচনা করতে যাচ্ছি না। ছন্দ সম্পর্কে আমার আদৌ কোনো জ্ঞান নেই এবং ছন্দের আদর্শ অনুযায়ী এর বিচার সঠিক হবে কিনা তাও জানি না। সাহিত্যিক নই বলে জাতীয় সাহিত্যে এর কঠিন স্থান নির্ণয় করার উদ্দেশ্যেও এর আলোচনা আমি করব না।
যেহেতু আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী, সেজন্য কেবলমাত্র বড়জোর ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে আমি এর আলোচনা করতে পারি। কিন্তু এখানেও একটা বিষয় আমার কাজটাকে অসম্ভব বা অন্তত খুবই কঠিন করে তুলেছে। নিয়ম মতো ভূমিকা সব সময়ই এমন ব্যক্তি দ্বারা লিখিত হয় যিনি গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্পর্কে গ্রন্থকারের সঙ্গে অন্তত এক মত। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে সব বিষয়ে একমত নই। তিনি জানতেন যে বেশ কয়টি মুখ্য বিষয়ে আমি তার থেকে ভিন্ন মত পোষণ করি। সুতরাং আমার লেখা আদৌ কোন ভূমিকা হবে না। বড়জোর তা হবে একটা সমালোচনা এবং এর স্থান গ্রন্থের প্রারম্ভে না হয়ে হবে শেষে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দি ড্রিমল্যান্ড-এর স্থান গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান অবস্থায় আন্দোলনের একটা প্রধান শূন্যতাও এটি পূর্ণ করেছে, বস্তুতপক্ষে আমাদের ইতিহাসে এ পর্যন্ত কিছুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এমন সব রাজনৈতিক আন্দোলনেই যে আদর্শ তারা অর্জন করতে চান সে সম্বন্ধে ধারণার অভাব আছে। বিপ্লবী আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম নয়। আমার সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমি এমন কোনো বিপ্লবী দল খুঁজে পাইনি কিসের জন্য সংগ্রাম করছেন সে সম্পর্কে যাঁদের কোনো পরিষ্কার ধারণা আছে। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো গদর পার্টি যারা ইউ এস এ ধরনের সরকার কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেছেন যে প্রজাতান্ত্রিক ধরনের সরকার দ্বারা বর্তমান সরকারের পরিবর্তন তারা করতে চান। অন্যান্য সকল দলেই এমন সব ব্যক্তি রয়েছেন যাদের একমাত্র আদর্শ বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। আদর্শটি খুবই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু তাকে বৈপ্লবিক আদর্শ বলে গণ্য করা যায় না। আমাদের এটা পরিষ্কার করে দিতে হবে যে বিপ্লব বলতে শুধুমাত্র একটা অভ্যুত্থান, রক্তাক্ত সংঘর্ষ বোঝায় না, বিপ্লব আবশ্যিকভাবে বর্তমানে প্রচলিত অবস্থার (অর্থাৎ রাজত্বের) পরিপূর্ণ ধ্বংস সাধনের পর, নতুন এবং সুউন্নত ভিত্তিতে সমাজে সুবিন্যস্ত পুনর্গঠনের কর্মসূচীকে বোঝায়।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নরমপন্থীরা বর্তমান সরকারের অধীনেই কিছু সংস্কার চেয়েছিলেন, চরমপন্থীরা সেখানে আর একটু বেশি দাবি করেছিলেন এবং সেই উদ্দেশ্যে মৌলিক পন্থা অবলম্বন করতে প্রস্তুত ছিলেন। বিপ্লবীরা সব সময়েই চরমপন্থার অনুকূলে ছিলেন, উদ্দেশ্য একটিই, বিদেশী শাসন অপসারণ করা। সন্দেহ নেই, এমন কিছুও ছিলেন যারা ঐ উপায়ের মাধ্যমে কিছু সংস্কার সাধনের অনুকূলে ছিলেন। এইসব আন্দোলনকে সঠিকভাবে বিপ্লবী আন্দোলন বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে না।
[আরও পড়ুন: সবই ব্যাদে আছে - মেঘনাদ সাহা]
কিন্তু এল রামশরণ দাশই হলেন প্রথম বিপ্লবী যাকে পাঞ্জাব প্রদেশে আত্মগোপনকারী এক বাঙালী বিপ্লবী ১৯০৮ সালে দলভুক্ত করেন। তখন থেকে তিনি বিপ্লবী আন্দোলনের সংস্পর্শে আসেন এবং শেষ পর্যন্ত গদর পার্টিতে যোগদান করেন যদিও আন্দোলনের আদর্শরূপে তারা যা গ্রহণ করেছিলেন সেই পুরনো ধারণাগুলো তিনি ধরে রেখেছিলেন। এই বইয়ের চমৎকারিত্ব ও মূল্যের সঙ্গে আরও একটা জিনিস যোগ করে দিতে হয়। এল রামশরণ দাশকে ১৯১৫ সালে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং পরে সেই দণ্ডাদেশ মকুব করে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সেলে নিজে বসে থেকে আজ আমি পাঠকদের প্রামাণিকভাবে জানিয়ে দিতে পারি যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করা তুলনামূলকভাবে মৃত্যুদণ্ডাদেশের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। এল রামশরণ দাশকে বাস্তবিক চৌদ্দ বৎসর কারাদন্ড ভোগ করতে হয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলের কোনো এক কারাগারে তিনি এই কবিতা লিখেছেন। গ্রন্থকারের তখনকার মানসিক অবস্থা ও দ্বন্দ্বের ছাপ কবিতার ওপর পড়েছে এবং একে অধিকতর আকর্ষণ করে তুলেছে। তিনি যে লিখবেন তা ঠিক করার পূর্বে তাকে নৈরাশ্যময় মানসিক অবস্থার সঙ্গে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছিল। তাঁর অনেক সহকর্মীকেই তখন মুচলেকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছিল। তার এবং প্রত্যেকের মধ্যেই কাজ করছিল এই লোভ। স্ত্রী ও সন্তানদের মধুর করুণ স্মৃতি যখন মুক্তির ইচ্ছাকে প্রবলতর করছিল তখন তাঁকে ঐ সবের মনোবল ভঙ্গকারী পরিণতির বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছিল। সে সময়ই তাঁকে এই কাজের প্রতি মনোযোগ আকৃষ্ট করতে হয়। এ জন্য প্রারম্ভিক অনুচ্ছেদে আমরা তার আকস্মিক বিস্ফোরণ দেখতে পাই–
বিষধরা সপিণীর আবেষ্টনী সম
দারা-শিশু-বন্ধুজন আছে যত মম।
শুরুতে তিনি দর্শন আলোচনা করেছেন। বাংলা ও পাঞ্জাবের সমস্ত বিপ্লবী আন্দোলনের মেরুদণ্ড হচ্ছে এই দর্শন। এ প্রশ্নে আমার সঙ্গে তাঁর বিস্তর মত-পার্থক্য। বিশ্বজগৎ সম্পর্কে ব্যাখ্যা উদ্দেশ্যবাদী ও আধ্যাত্মিক। সেখানে আমি বাস্তববাদী ও ঘটনা সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যা হবে কার্যকারণিক। তা সত্ত্বেও, কোনো মতেই তা স্থান ও কালের বাইরে নয়। তিনি যে ধারণা ব্যক্ত করেছেন, আমাদের দেশে তা-ই অধিকতর পরিচিত। বিষন্ন মানসিক অবস্থার সঙ্গে লড়াই করার জন্য তিনি প্রার্থনা করতে আরম্ভ করেন। এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় তাঁর পুস্তকের শুরুটা যেভাবে ঈশ্বর, তাঁর স্তুতি, তাঁর সংজ্ঞা ইত্যাদিতে পূর্ণ, তা থেকে। ঈশ্বরে বিশ্বাস হচ্ছে, অতীন্দ্রিয়বাদের পরিণাম, যে অতীন্দ্রিয়বাদ হলো হতাশার স্বাভাবিক পরিণতি। এ পৃথিবী যে মায়া, অথবা মিথ্যা, একটা স্বপ্ন বা অলীক কাহিনী, ঐ হচ্ছে পরিষ্কার অতীন্দ্রিয়বাদ যা শঙ্করাচার্য প্রমুখ প্রাচীন যুগের হিন্দু ঋযিদের দ্বারা সৃষ্ট ও প্রচারিত। কিন্তু, বস্তুবাদী দর্শনে এ ধরনের চিন্তাভাবনার আদৌ কোনো স্থান নেই। তবে গ্রন্থকারের এই অতীন্দ্রিয়বাদ কোনমতেই হীন বা নিন্দনীয় নয়। এর নিজস্ব একটা সৌন্দর্য ও মাধুর্য রয়েছে। ধারণাগুলি উদ্দীপনাপূর্ণ। দেখুন শুধু–
চোখের আড়ালে যে ভিত
কি আনন্দে বিরাট সৌধ বুকে রেখেছে
অনেক যন্ত্রণার প্রকৃত আশ্রয়স্থল
পার্থিব সব প্রশস্তি যেখানে বর্ষিত
সেই মসৃণ শীর্ণ ফলককে হিংসা করো না।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নিঃসন্দেহে আমি বলতে পারি যে গোপনীয় কাজে আশাহীন ও ভয়হীন অবস্থায় যখন কোনো মানুষ অবিরাম বিপদের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করে, অজ্ঞাত, অসম্মানিত ও অ-নন্দিত অবস্থায় জীবন বিসর্জন দিতে সর্বদাই প্রস্তুত থাকে তখন এই ধরনের অতীন্দ্রিয়বাদ দ্বারা তার ব্যক্তিগত প্রলোভন ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে লড়াই না করে সে পারে না। এই অতীন্দ্রিয়বাদ মনোবল ভঙ্গকারী নয়, পরবর্তী যে বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন তা যে বিপ্লবীদের মানসিকতা। এল রামশরণ দাশ ছিলেন এমন একটি বিপ্লবী দলের সদস্য অনেক হিংসাত্মক কাজকর্মের জন্য যাদের দায়ী করা হয়। কিন্তু কোনো মতেই তা প্রমাণ করে না যে বিপ্লবীরা হলো রক্তপিপাসু দস্যু বিশেষ যারা ধ্বংসের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়। পড়ুন–
প্রয়োজনে বাহ্যত হয় বন্য
হৃদয়ে রেখো মিগ্ধ কোমলতা
দংশন নয়, ছোবলে ফুঁসে ওঠা
বাইরে কঠিন অন্তরে প্রেম ধন্য।
নির্মাণের জন্য ধ্বংস শুধু প্রয়োজনীয় নয় অপরিহার্যও বটে। বিপ্লবীদের তাদের কর্মসূচীর মধ্যে একে আবশ্যক উপাদানরূপে গ্রহণ করতে হয় এবং হিংসা ও অহিংসার দর্শন উপরের পংক্তিগুলিতে অতি চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। এক সময় লেনিন গোর্কিকে বলেছিলেন যে তিনি এমন কোনো সঙ্গীত শুনতে পারেন না যা তার সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রকে বিকল করে দেয় এবং শিল্পীর মাথায় তখন চাপড় মারার ইচ্ছা জাগে। তিনি বলেছেন, কিন্তু এ মাথা চাপড়ানোর সময় নয়। হাত এখন এগিয়ে এসেছে মাথার খুলি ভেঙে দেওয়ার জন্য যদিও আমাদের চরম লক্ষ্য হচ্ছে সমস্ত রকমের হিংসার অবসান ঘটানো। প্রচণ্ড প্রয়োজনের তাগিদে বিপ্লবীরা যখন সহিংস পন্থা অনুসরণ করেন তখন তারা সত্যই একথা অনুভব করেন।
গ্রন্থকার এর পরে পরস্পর-বিরোধী বিভিন্ন ধর্মমত নিয়ে আলোচনা করেছেন। সমস্ত জাতীয়তাবাদীরা যেমন চেষ্টা করেন তিনিও তেমনি তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেছেন। সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁর যে পদ্ধতি তা দীর্ঘ ও ঘোরালো, যদিও আমি হলে কার্ল মার্কসের একটি কথা দিয়েই তা নাকচ করে দিতাম, ধর্ম হচ্ছে জনগণের পক্ষে আফিং।
সর্বশেষে আসে তার কবিতার সবচেয়ে প্রধান অংশ যেখানে তিনি যে ভবিষ্যৎ সমাজ আমরা সকলেই সৃষ্টি করতে চাই তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু প্রথমেই আমি একটি কথা পরিষ্কার বলতে চাই। দি ড্রিমল্যান্ড হচ্ছে একটি যথার্থ স্বপ্ন রাষ্ট্র। নামকরণের মধ্যেই গ্রন্থকার অকপটে তা স্বীকার করে নিয়েছেন। ঐ বিষয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব লিখেছেন এমন ভাণও তিনি করেননি। ড্রিমল্যান্ড-এর নামকরণ তা বেশ ভালভাবেই পরিষ্কার করছে। কিন্তু স্বপ্ন রাষ্ট্র নিঃসন্দেহে সামাজিক প্রগতিতে এক বিরাট ভূমিকা পালন করে। সেন্ট সাইমন, ফুরিয়ের ও রবাট ওয়েন্ এবং তাদের তত্ত্ব ব্যতীত বৈজ্ঞানিক মার্কসীয় সমাজতন্ত্র আসত না। এল রামশরণ দাশের স্বপ্নরাষ্ট্র ঐ একই স্থান দখল করে। যখন আন্দোলনের দর্শনকে প্রণালীবদ্ধ করার এবং আন্দোলন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করার গুরুত্ব আমাদের কাজে উপলব্ধি করা যাবে তখন এই বইটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।
আমি বলেছি যে প্রকাশভঙ্গিটা স্থূল রকমের। যখন তিনি স্বপ্নরাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা করছেন তখন কোনো মতেই বর্তমান সমাজের ধ্যানধারণার সংস্পর্শ থেকে তিনি দূরে থাকেননি।
যাদের প্রয়োজন তাদের ভিক্ষা দেওয়া ভবিষ্যৎ
সমাজে অর্থাৎ যে সাম্যবাদী সমাজ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই সেখানে আমরা দাতব্য প্রতিষ্ঠান খুলতে যাচ্ছি না। অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্র সেখানে থাকবেই না, থাকবে না ভিক্ষা দান ও ভিক্ষা গ্রহণ। তা সত্ত্বেও সমস্যাটা অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
যে সাধারণ রূপরেখা তিনি উপস্থাপিত করেছেন তা একেবারে বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের রূপরেখার মতোই। কিন্তু এমন বিষয়ও আছে যার প্রতিবাদ, বিরুদ্ধতা বা সঠিকভাবে বলতে গেলে সংশোধন করতে হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ৪২৭ নং স্তবকের পাদটীকায় তিনি লিখেছেন যে, জীবিকা অর্জনের জন্য সরকারী কর্মচারীদের প্রত্যহ চার ঘন্টা খাটতে হবে। এটা কিন্তু কাল্পনিক ও অকার্যকরী। এ বরং বর্তমান অবস্থার প্রতি ঘৃণার ফল যে ব্যবস্থায় সরকারী কর্মচারীদের অযৌক্তিকভাবে অনেক বেশি বেতন দেওয়া হয়ে থাকে। বস্তুতপক্ষে বলশেভিকদেরও স্বীকার করতে হয়েছিল যে মানসিক পরিশ্রম শারীরিক পরিশ্রমের মতোই সৃজনশীল। ভবিষ্যৎ সমাজব্যবস্থায় যখন সাম্যের ভিত্তিতে সমাজের বিভিন্ন অপরিহার্য অংশের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হবে তখন উৎপাদনকারী ও বন্টনকারী উভয়েই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। কোনো নাবিক প্রতি চব্বিশ ঘন্টা অন্তর একবার তার জাহাজ থামিয়ে জীবিকা অর্জনের উদ্দেশ্যে চার ঘন্টার প্রাত্যহিক শ্রম করার জন্য অবতরণ করবে কিংবা কোনো বৈজ্ঞানিক মাঠে তার নির্ধারিত অংশের শ্রমটুকু করার জন্য তার গবেষণাগার ও পরীক্ষণ ছেড়ে আসবে তা কেউ আশা করতে পারে না। এরা দুজনেই উৎপাদনশীল শ্রম করছে। কেবলমাত্র পার্থক্য হলো সমাজতান্ত্রিক সমাজ আশা করে না যে আর কখনও বুদ্ধিজীবীরা শারীরিক শ্রমজীবীদের থেকে উন্নততর বলে গণ্য হবে।
এল রামশরণ দাশের অবৈতনিক শিক্ষা সংক্রান্ত ধারণা সত্যি সত্যিই বিবেচনার যোগ্য এবং রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রায় একই পথ গ্রহণ। করেছে।
বাস্তবিকপক্ষে সব থেকে বেশি অগ্রগামী চিন্তার ধারক অপরাধ সম্পর্কে তাঁর আলোচনা, অপরাধ হচ্ছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা যা অত্যন্ত কুশলী হস্তক্ষেপ দাবি করে। তিনি তাঁর জীবনের একটা বড় অংশ জেলে কাটিয়েছেন, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর আছে, এক জায়গায় তিনি হাল্কা শ্রম, মাঝারি শ্রম, কঠোর শ্রম প্রভৃতি একেবারে জেলের ভাষা ব্যবহার করেছেন। অন্যান্য সকল সমাজতন্ত্রীর মতোই তিনি প্রতিশোধাত্মক তত্ত্বের পরিবর্তে সংশোধনাত্মক তত্ত্বের পক্ষে অভিমত দিয়েছেন। শাস্তিদান, সংশোধনই বিচারের পরিচালিকা শক্তি হিসাবে গৃহীত হওয়া উচিত। জেলগুলো যথার্থ নরক না হয়ে সংশোধনাগার হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এই প্রসঙ্গে রাশিয়ার ব্যবস্থা সম্পর্কে পাঠকের জ্ঞানার্জন করা উচিত।
সেনাবাহিনী নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি যুদ্ধ সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন, আমার মতে তখন যুদ্ধের স্থান হবে জ্ঞানকোষের কয়েকটি পৃষ্ঠায় মাত্র। যুদ্ধের সরঞ্জাম মিউজিয়ামের লম্বা বারান্দায় শোভাবর্ধন করবে, কারণ বিরুদ্ধ বা বিভিন্ন স্বার্থ যা থেকে যুদ্ধের জন্ম হয় তা থাকবে না।
খুব বেশি হলে আমরা বলতে পারি যুগ পরিবর্তনের সময় প্রতিষ্ঠানরূপে যুদ্ধকে রাখতে হবে। আমরা যদি আধুনিক রাশিয়ার দৃষ্টান্ত নিই তাহলে সহজেই ব্যাপার হৃদয়ঙ্গম করতে পারি। সেখানে বর্তমানে সর্বহারার একনায়কত্ব। তারা সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, ধনতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করার জন্য ইতিমধ্যে তাদের একটা সেনাবাহিনী রাখতে হয়। কিন্তু যুদ্ধের লক্ষ্য হবে ভিন্নতর। সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য আর আমাদের স্বপ্নের দেশের লোকেদের যুদ্ধ বাধাতে প্ররোচিত করবে না, যুদ্ধ জয়ের জন্য আর কোনো স্মৃতিচিহ্ন থাকবে না। শাসন করার জন্য বা জনগণকে লুণ্ঠন করার জন্য অন্য দেশে বিপ্লবী সেনাবাহিনী অবতরণ করবে না। তারা সিংহাসন থেকে নামিয়ে আনবে পরাভূত শাসকদের, বন্ধ করবে তাদের রক্তচোষা শোষণ এবং এভাবে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি আনবে। কিন্তু আমাদের মানুষগুলোকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করার জন্য আদিম যুগের জাতীয় বা জাতিগত বিদ্বেষ থাকবে না।
সমস্ত স্বাধীনচেতা মানুষের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও প্রত্যক্ষ লক্ষ্য হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন এবং গ্রন্থকার বেশ ভালভাবেই সবিস্তারে এ বিষয়ে বলেছেন এবং তার তথাকথিত লীগ অব নেশনস-এর আলোচনা খুবই সুন্দর।
সংক্ষিপ্ত করে হলেও গ্রন্থকার ৫৭১ (৫৭২) নং স্তবকের পাদটীকায় পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, দৈহিক সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে এ ধরনের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বাহির থেকে সমাজের উপর একে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। ভিতর থেকে এর বিকাশ ঘটাতে হবে ………। বিবর্তনের ক্রমিক ধারার উপরে উল্লিখিত উপায়ে শিক্ষিত করে তুলে তা প্রতিষ্ঠা করা যায়। ইত্যাদি। এ বিবৃতিতে এমনিতে কোনো অসামঞ্জস্য নেই। এ সম্পূর্ণ সঠিক। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যাত না হওয়ায় কিছু ভুল বোঝাবুঝির অথবা আরও খারাপ হলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। এ কি এই বোঝায় যে এল রামশরণ দাশ অহিংস আন্দোলনের অযাথার্থতা হৃদয়ঙ্গম করেছেন? তিনি কি অহিংসায় গোঁড়া বিশ্বাসী হয়ে গিয়েছেন? না, তা বোঝায় না।
উপরে উদ্ধৃত বিবৃতি কি বোঝায় তা ব্যাখ্যা করা যাক। বিপ্লবীরা অন্যদের চেয়ে ভালভাবেই জানেন যে সমাজতান্ত্রিক সমাজ শুধুমাত্র সহিংস উপায়ে আনা যায় না। ভিতর থেকে এর বিকাশ ও বিবর্তন ঘটা উচিত। গ্রন্থকার প্রয়োগের জন্য শিক্ষাকেই একমাত্র অস্ত্র বলে মত দিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেকে সহজেই বুঝতে পারেন যে এখানে বর্তমান সরকার বা বস্তুতপক্ষে সমস্ত ধনতান্ত্রিক সরকার এ ধরনের প্রচেষ্টাকে সাহায্য তো করবেই না বরং উল্টোদিকে নির্দয়ভাবে তাকে দমন করবে। তাহলে তার বিবর্তন কি অর্জন করবে? আমরা বিপ্লবীরা আমাদের হাতে সকল ক্ষমতা অধিকার করার এবং বিপ্লবী সরকার সংগঠিত করার চেষ্টা করছি যে সরকার জনশিক্ষার জন্য তার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করবে যেমনটি বর্তমান রাশিয়ায় ঘটছে। ক্ষমতা দখলের পর গঠনকাজে শান্তিপূর্ণ উপায় প্রয়োগ করা হবে, বাধা অতিক্রম করার জন্য বলপ্রয়োগ করা হবে। গ্রন্থকার যদি তাই বুঝিয়ে থাকেন তা হলে আমরা একমত তিনি যে এটাই বোঝাতে চান সে সম্পর্কে আমি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল।
আমি পুস্তকটির বিস্তৃত আলোচনা করেছি, বরং বলা যায় সমালোচনা করেছি। কিন্তু এর কোনো সংশোধন করতে আমি বলব না, কারণ এর একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এগুলি হলো ১৯১৪-১৫ সালের বিপ্লবীদের মনোভাব।
আমি বিশেষ করে তরুণদের জন্য এ বইটি অনুমোদন করি–কিন্তু একটি সতর্কবাণীসহ। অন্ধভাবে অনুসরণ করার জন্য এ বই পড়বেন না এবং এতে যা লেখা আছে তা বেদবাক্য বলে গ্রহণ করবেন না। পড়ুন, সমালোচনা করুন, এ সম্পর্কে চিন্তা করুন এবং এর সাহায্যে আপনার নিজস্ব মতামত গঠন করতে চেষ্টা করুন।