গৌতম বুদ্ধের সিদ্ধান্ত - কোনো গ্ৰন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসেবে স্বীকার না করা
স্বতঃপ্রমাণ হবার দাবি একমাত্র একটি গ্ৰন্থই করে না। সমস্ত ধর্মই নিজ নিজ ধর্মগ্ৰন্থকে স্বতঃপ্রমাণ বলে মানে এবং অপরকে মানাবার চেষ্টা করে। ব্রাহ্মণরা বেদকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে মানে। তার অনেক বক্তব্য অন্য ধর্মের বক্তব্যের এবং বিজ্ঞানের প্রয়োগ দ্বারা প্রমাণিত তত্ত্বের বিরোধী। তারপরেও এরকম কোনো গ্ৰন্থকে স্বতঃপ্রমাণ বলে কীভাবে মানা যায়? যদি বলা হয়, বেদ বিজ্ঞানসম্মত প্রয়োগ-সিদ্ধান্তের বিরোধী নয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে–এটাই বা কীভাবে জানা গেল? তার প্রমাণের জন্য শেষ পর্যন্ত বুদ্ধির আশ্রয়ই নিতে হবে। এর দ্বারা এটাই কি প্রমাণিত হয় না যে বেদের চেয়ে বুদ্ধিই স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে গৃহীত হবার দাবি করতে পারে। যে কথা এখানে বেদ সম্বন্ধে বলা হল, সে কথাই বাইবেল, এঞ্জেল, কোরান ইত্যাদি স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে স্বীকৃত গ্ৰন্থ সম্বন্ধে প্রযোজ্য। বস্তুত যখন ঈশ্বরই নেই, তখন ঈশ্বরের গ্ৰন্থ কোথা থেকে আসবে?
গ্ৰন্থকে স্বতঃপ্রমাণ মানার জন্য যুগে যুগে পৃথিবী জুড়ে কতো না অত্যাচার সংঘটিত হয়েছে। বাইবেলকে স্বতঃপ্রমাণ না মানলে গ্যালিলিওর ওই দুর্গতি হত না। আরও অনেক বৈজ্ঞানিক চেতনাসম্পন্ন মানুষকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হত না, যদি না বাইবেল স্বতঃপ্রমাণের দাবি নিয়ে উপস্থিত হত। যবন তত্ত্বজ্ঞানীদের সহস্রাব্দীর চিন্তার ফল গ্ৰন্থরূপে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্ৰন্থাগারে সুরক্ষিত ছিল। সেই গ্ৰন্থাগার সহ গোটা নগরীকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হত না, যদি না মুসলিম বিজেতারা কোরানকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে মানত। কোনো গ্ৰন্থকে স্বতঃপ্রমাণ মানার অর্থই হল পরমত অসহিষ্ণুতা। এই গ্ৰন্থ-মান্যতা সারা পৃথিবী জুড়ে হাজার বছর ধরে মনুষ্য জাতিকে ধমান্ধতা, অন্ধবিশ্বাস আর মানসিক দাসত্বের গাঢ় অন্ধকারে শুধু ফেলেই রাখেনি, মানুষের সমাজজ্ঞানের উন্মেষের পক্ষেও বাধার প্রাচীর খাড়া করেছে যার ফলস্বরূপ পৃথিবী বারবার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। খ্রিস্টানদের তথাকথিত ক্রুসেড ধর্মযুদ্ধ আদতে কী ছিল? কারণ ছিল, বাইবেল না কোরান স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে কে মান্যতা পাবে।
কোনো গ্ৰন্থকে স্বতঃপ্রমাণ মানার অর্থ, গ্ৰন্থে বর্ণিত বিষয় সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন তোলার অধিকার না থাকা এবং জিজ্ঞাসার অগ্ৰগতি রোধ করা। জিজ্ঞাসাই বিশ্বে বড়ো বড়ো আবিষ্কারের সৃষ্টিকর্তা। যদি গ্যালিলিও বাইবেলের মত অনুযায়ী পৃথিবীকে গোল না বলে চ্যাপ্টা বলে মেনে নিতেন, তাহলে মনুষ্য সমাজকে আরও কতকাল না জানি ওই ভ্রান্ত ধারণা বহন করে নিয়ে চলতে হত। যদি কোপারনিকাস বাইবেলের বর্ণনানুযায়ী সূর্য সমন্ধীয় তত্ত্ব মেনে নিতেন, তাহলে পৃথিবী কর্তৃক সূর্য প্রদক্ষিণের আহ্নিক এবং বার্ষিক গতির আবিষ্কার কী করে হত? বস্তুত গ্ৰন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে মানলে নিউটনের ‘মাধ্যাকর্ষণ শক্তির’ খোঁজও পাওয়া যেত না এবং আইনস্টাইনও তাঁর উন্নত পর্যায়ের আপেক্ষিকতাবাদের মহান সিদ্ধান্তের আবিষ্কারে সমর্থ হতেন না। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বে জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্পকলা ইত্যাদির যে প্রগতি ঘটেছে, যার ফলে মানব সভ্যতার অগ্ৰগতি সম্ভব হয়েছে, তার সবটাই ঘটেছে কোনো গ্ৰন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে না মেনে। ব্যবহারিক জীবনে কোন ব্যক্তি ধর্মগ্ৰন্থের প্রামাণিকতা সর্বাংশে মেনে চলে? গ্ৰন্থগুলির সবকটিই তার নিজের কালের প্রতিবন্ধকতা, অন্ধবিশ্বাস আর অজ্ঞানতায় ভরা। ওগুলি তাদের কালের ধার্মিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার পরিপোষক। হাজার হাজার বছরের ব্যবধানে ওই সমস্ত তত্ত্ব পচা-গলা লাশে পরিণত হয়েছে, তবুও কেউ কেউ ওই গলিত মৃতদেহকেই কন্ঠলগ্ন করতে আগ্ৰহী। সেন্টপলের সময় মেয়েদের মাথায় ঘোমটা জাতীয় আচ্ছাদন দেবার রেওয়াজ ছিল, লোকে তার মধ্যে সুরুচির পরিচয় পেত। সেই প্রথাকে উদাহরণ হাসাবে খাড়া করে আজও ইউরোপে মেয়েদের গির্জা কিংবা আদালতে শপথ নেবার সময় বাধ্যতামূলক ভাবে মাথায় টুপি পড়তে হয়, অথচ বর্তমানে দৈনন্দিন জীবনে আর কোনো ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা বিন্দুমাত্র অনুভূত হয় না।
গ্ৰন্থকে স্বতঃপ্রমাণ মানলে, তার স্রষ্টাকে সর্বজ্ঞ বলে মানতে হয়। এবং তাও সমস্ত দেশ, কাল ও বস্তু সম্বন্ধে। যদি কোনো সর্বজ্ঞ আমাদের জন্মের হাজার বছর আগেই আমাদের দ্বারা কৃত ভালোমন্দ সমস্ত কর্ম সম্বন্ধেই ওয়াকিবহাল ছিলেন, তাহলে তো বলতে হয় আমরা সেই সমস্ত কর্ম করতে বাধ্য, অন্যথায় সেই সর্বজ্ঞের সর্বজ্ঞতা মিথ্যা হয়ে যাবে। তাহলে মানুষ কি প্রকৃতপক্ষে এরকম সর্বজ্ঞের হাতের কাঠের পুতুল মাত্র নয়? কাঠের পুতুলের কি কোনো অধিকার থাকে যাতে সে বাছবিচার করতে পারে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ। তাহলে এরকম ধর্ম, তার গ্ৰন্থ এবং সেখানে বর্ণিত জ্ঞানের কী প্রয়োজন?
পরিশুদ্ধ ও মুক্ত হবার কর্মে মানুষের স্বাতন্ত্র অত্যন্ত জরুরি। কর্মের স্বাধীনতার জন্য বুদ্ধির স্বাধীনতার প্রয়োজন। বুদ্ধির স্বাধীনতার জন্য কোনো গ্ৰন্থের অধীনতাপাশে আবদ্ধ থাকাটা অপ্রয়োজনীয়। বস্তুত কোনো গ্ৰন্থের প্রামাণিকতা নির্ধারিত হয় বুদ্ধির দ্বারা, বুদ্ধির প্রামাণিকতা নির্ধারণের জন্য কোনো গ্ৰন্থেরই কোনো ভূমিকা নেই।
তথ্যসূত্রঃ বৌদ্ধ দর্শন - রাহুল সাংকৃত্যায়ন