কৃষ্ণের মুখে গীতার বাণী শুনে অর্জুনের কি উপকার হয়েছিল?
Arjun forgot lessons of Gita
অর্জুন গীতার বাণী ভুলে গিয়েছিলেন
গীতার বাণী |
গল্পটা আমরা কমবেশি সবাই জানি। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে (এই যুদ্ধ কবে হয়েছিল তার কোনো সঠিক হিসাব নেই, বহু পণ্ডিতের দিনকাল গণণার হিসাবে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে আবার সত্যিই এই যুদ্ধ হয়েছিল কিনা তাও সন্দেহ আছে) পাণ্ডব বীর অর্জুন শত্রুপক্ষে নিজের ভাইদের, পিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্য এবং বহু স্বজন মানুষদের দেখে যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর অর্জুনের সারথী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ (সত্যিই ভগবানের অস্তিত্ব আছে বা ছিল কিনা জানা নেই) অর্জুনের মোহভঙ্গের জন্য উপদেশ দেন – সেই উপদেশাবলীর সংকলন গ্ৰন্থই হল 'শ্রীমদ্ভগবদগীতা'।
এই গীতার চতুর্থ অধ্যায় জ্ঞানযোগ-এর ৩৫ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,যজ্জ্ঞাত্বা ন পুনর্মোহমেবং যাস্যসি পাণ্ডব।
যেন ভূতান্যশেষাণি দ্রক্ষ্যসাত্মন্যথো ময়ি।।
অনুবাদ: হে পাণ্ডব! এভাবে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে তুমি আর মোহগ্ৰস্ত হবে না, কেন না এই জ্ঞানের দ্বারা তুমি দর্শন করবে যে, সমস্ত জীবই আমার বিভিন্ন অংশ অর্থাৎ তারা সকলেই আমার এবং তারা আমাতে অবস্থিত।
সূত্র: শ্রীমদ্ভগবদগীতা যথাযথ, চতুর্থ অধ্যায় - জ্ঞানযোগ, শ্লোক ৩৫ – শ্রীল প্রভুপাদ (ইসকন)
কিন্তু সত্যিই কি গীতার নিষ্কাম কর্ম অর্জুনের দীর্ঘসময়ের জন্য উপকারী হয়েছিল? রাজশেখর বসু তাঁর মহাভারতের অনুবাদের ভূমিকায় বলেছেন,
অশ্বমেধিক পর্বে অনুগীতাপর্বাধ্যায়ে অর্জুন ও কৃষ্ণের মধ্যে এরূপ কথোপকথন রয়েছে।
এই সম্পর্কে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর "কৃষ্ণচরিত্র" গ্ৰন্থে বলেছেন,
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বক্ষণে কৃষ্ণ অর্জুনকে যে গীতার উপদেশ শুনিয়েছিলেন তা পেয়ে জগতের লোক ধন্য হয়েছে। অর্জুনের 'ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য' দূর হয়েছিল, কিন্তু কোনো স্থায়ী উপকার হয়েছিল কিনা সন্দেহ। অশ্বমেধিক পর্বে অর্জুন কৃষ্ণের কাছে স্বীকার করেছেন যে বুদ্ধির দোষে তিনি পূর্বের উপদেশ ভুলে গেছেন।
একদা এক রমণীয় স্থানে বিচরণ করতে করতে অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন কেশব, সংগ্ৰামের সময় আমি তোমার মাহাত্ম্য জেনেছিলাম, তোমার দিব্য রূপ ও ঐশ্বর্যও দেখেছিলাম। তুমি সুহৃদ্ভাবে আমাকে পূর্বে যে সকল উপদেশ দিয়েছিলে আমি বুদ্ধির দোষে তা ভুলে গেছি। তুমি শীঘ্রই দ্বারকায় ফিরে যাবে, সেজন্য এখন আবার সেই উপদেশ শুনতে ইচ্ছা করি। অর্জুনকে আলিঙ্গন করে কৃষ্ণ বললেন, আমি তোমাকে নিগূঢ় সনাতন ধর্মতত্ত্ব এবং শাশ্বত লোক সম্বন্ধে উপদেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু বুদ্ধির দোষে তুমি তা গ্ৰহণ করতে পারনি, এতে আমি দুঃখিত হয়েছি। আমি যোগমুক্ত হয়ে পূর্বে যে ব্রহ্মতত্ত্ব বিবৃত করেছিলাম এখন আর তা বলতে পারব না। যাই হক, এক সিদ্ধ ব্রাহ্মণ ধর্মাত্মা কশ্যপকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তাই আমি বলছি শোন।
সূত্র: মহাভারত সারানুবাদ, অশ্বমেধিক পর্ব, অনুগীতাপর্বাধ্যায় - রাজশেখর বসু
ধর্মরাজ্য সংস্থাপিত হইল; ধর্ম প্রচারিত হইয়াছে। পাণ্ডবদিগের সঙ্গে কৃষ্ণের জন্য এ গ্ৰন্থের সম্বন্ধ; মহাভারতে যেজন্য কৃষ্ণের দেখা পাই, তাহা সব ফুরাইল। এইখানে কৃষ্ণের মহাভারত হইতে অন্তর্হিত হওয়া উচিত। কিন্তু রচনাকণ্ডূতিপীড়িতেরা তত সহজে কৃষ্ণকে ছাড়িবার পাত্র নহেন। ইহার পরে অর্জুনের মুখে তাঁহারা একটা অপ্রাসঙ্গিক, অদ্ভুত কথা তুলিলেন। তিনি বলিলেন, তুমি আমাকে যুদ্ধকালে যে ধর্মোপদেশ দিয়াছিলে, সব ভুলিয়া গিয়াছি। আবার বল। কৃষ্ণ বলিলেন, কথা বড় মন্দ। আমার আর সেসব কথা মনে হইবে না। আমি তখন যোগমুক্ত হইয়াই সে সব উপদেশ দিয়াছিলাম। আর তুমিও বড় নির্বোধ ও শ্রদ্ধাশূণ্য; তোমায় আর কিছুই বলিতে চাহি না। তথাপি এক পুরাতন ইতিহাস শুনাইতেছি।
কৃষ্ণ ঐ ইতিহাসোক্ত ব্যক্তিকে অবলম্বন করিয়া, অর্জুনকে আবার কিছু তত্ত্বজ্ঞান শুনাইলেন। পূর্বে যাহা শুনাইয়াছিলেন তাহা গীতা বলিয়া প্রসিদ্ধ। এখন যাহা শুনাইলেন, গ্ৰন্থকার তাহার নাম রাখিয়াছেন “অনুগীতা”। ইহার এক ভাগের নাম “ব্রাহ্মণগীতা”।
অনুগীতাও উত্তম গ্ৰন্থ।… কিন্তু গ্ৰন্থ যেমনই হউক, ইহাতে আমাদের কোন প্রয়োজন নাই। গ্ৰন্থ যেমনই হউক, ইহা কৃষ্ণোক্তি নহে। গ্ৰন্থকার বা অপর কেহ, যেরূপ অবতারণা করিয়া, ইহাকে কৃষ্ণের মুখে উক্ত করিয়াছেন, তাহাতে বোঝা যায় যে ইহা কৃষ্ণোক্ত নহে; জোড়া দাগ বড় স্পষ্ট, কষ্টেও জোড় লাগে নাই। গীতোক্ত ধর্মের সঙ্গে অনুগীতক্ত ধর্মে এরূপ কোনো সাদৃশ্য নাই যে, ইহাকে গীতাবেত্তার উক্তি বিবেচনা করা যায়। শ্রীযুক্ত কাশীনাথ ত্র্যম্বক নিজকৃত অনুবাদের যে দীর্ঘ অনুক্রমণিকা লিখিয়াছেন, তাহাতে সন্তোষজনক প্রমাণ প্রয়োগের দ্বারা এই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হইয়াছেন যে, অনুগীতা, গীতার অনেক শতাব্দী পরে রচিত হইয়াছিল।
এই "অনুগীতাপর্বাধ্যায়"-কে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাভারতের মূল অংশের বহির্ভূত এবং প্রক্ষিপ্ত বলেছেন,
তবে, অনুগীতা ও ব্রাহ্মণগীতা (বা ব্রহ্মগীতা) যে প্রকৃতপক্ষে প্রক্ষিপ্ত, তাহার প্রমাণার্থ ইহা বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, পর্বসংগ্ৰহাধ্যায়ে ইহার কিছুমাত্র প্রসঙ্গ নাই।
সূত্র: কৃষ্ণচরিত্র, ষষ্ঠ খণ্ড, দ্বাদশ পরিচ্ছেদ-কৃষ্ণপ্রয়াণ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
মহাভারত কোনো ব্যক্তিবিশেষের রচনা না। বর্তমান সময়ে সম্পূর্ণ মহাভারত শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত বলে হিন্দু সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস। কিন্তু একটু ভালো করে গবেষণা করলেই দেখা যায় মহাভারতে একাধিক কবির হাত রয়েছে। এজন্য চরিত্রগত অসঙ্গতি এবং একই ঘটনার একাধিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
এই অনুগীতাপর্বাধ্যায় অংশটিও প্রক্ষিপ্ত। তাহলে কি অর্জুন গীতার উপদেশ মনে রাখতে পেরেছিল? সেই সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়। এর পরেও অর্জুনের বহু অসঙ্গতি দেখা যায়। কিন্তু সত্যিই কি কৃষ্ণের উপদেশ অর্জুনের উপকারী হয়েছিল? গীতারবাণী ছিল অর্জুনকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য। আবার ভালো করে লক্ষ্য করলে মনে হয় কৃষ্ণ সুবিধাবাদী চরিত্র। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অবশ্য কৃষ্ণকে সুবিধাবাদী বলতে নারাজ।
গীতার নিষ্কাম কর্ম মতে – কর্ম করে যাও, ফলাফলের আশা করিও না। নিষ্কাম কর্মে পাপ করলেও মানুষ পাপী হয় না। এমন ধর্মমত শুনে অর্জুনের মনে হতে পারে নিষ্কাম কর্মে শত্রুপক্ষের পূজনীয় মানুষদের হত্যা করলেও সে পাপী হবে না। কৃষ্ণের নিষ্কাম কর্ম, অবাস্তব আত্মার কল্পনা, আত্মার অমরত্বের কল্পকাহিনী শুধুমাত্র অর্জুনকে পাপবোধ থেকে মুক্ত করার জন্য। এজন্য কৃষ্ণের নিষ্কাম কর্ম আপাতত মহান (বাস্তবে কোনো ধর্মই মহান না) মনে হলেও সেই ধর্মের কোনো কার্যকারিতা নেই। বাস্তবে কোনো ধর্মেরই কোনো কালেই কার্যকারিতা নেই।
যদি নিষ্কাম কর্ম মানা যায় তবে এইগুলো ক্ষেত্রে কী হবে জানা নেই –
- কোনো কর্মচারী কাজ করবে কিন্তু তার বেতনের আশা না করাই ভালো।
- কোনো শ্রমিক সারাদিন কাজ করবে কিন্তু সে যদি মালিকের কাছে মজুরি চায় তবে মালিক বলতেই পারে তুমি শ্রম দিয়ে যাও, তবে পারিশ্রমিক আশা করিও না।
- কোনো ছাত্রের পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট হবার পর সে যদি তার অভিভাবক ও শিক্ষকদের বলে, আমি রেজাল্টের আশা না করে পরীক্ষা দিয়েছি। গীতাকে পবিত্র গ্ৰন্থ মনে করা তার অভিভাবক ও শিক্ষকেরা কি সুবিধাবাদী ছাত্রের সুবিধাবাদী কৃষ্ণভক্তি মেনে নিবেন?
এমন আরও উদাহরণ দেওয়া যাবে। বাস্তবে কৃষ্ণের নিষ্কাম কর্ম শুধুমাত্র অর্জুনের না বরং আমাদের বর্তমান সময়েও কোনো উপকারী বিষয় না।
এরপরও যদি কেউ কৃষ্ণের নিষ্কাম কর্মকে মহান মনে করেন তবে সেই কৃষ্ণভক্তকে বলছি তিনি যেন কোনো কৃষ্ণভক্ত ব্রাহ্মণকে কৃষ্ণপূজার জন্য বাড়িতে ডেকে আনেন এবং পূজার পর কৃষ্ণভক্ত ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা না দিয়ে বলুন, ঠাকুরমশাই আপনি পূজা করে যান, দক্ষিণার আশা করবেন না।